আমাদের প্রত্যেকটি শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ কিন্তু এক জিনিস নয়। প্রত্যেকটি শিশুর কাজ করার ক্ষমতা এবং দক্ষতাই হলো বিকাশ এবং শিশুর দৈহিক ও আকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধি বুঝায়।
যেমন আমরা বলতে পারি বৃদ্ধি হচ্ছে আমাদের ওজন, উচ্চতা, মাথার পরিধি, বাহুর ব্যাস ও পায়ের দৈর্ঘ্য। অপরদিকে শারীরিক বিকাশ হচ্ছে বসতে পারা, হামাগুড়ি দেওয়া, বস্তু ধরে রাখা ইত্যাদি। যা আমাদের প্রত্যেকটি মানুষের বয়সের সাথে বিকাশিত হতে থাকে।
গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ বছর
একটি শিশুর মস্তিষ্কের ৯৫ শতাংশ গঠিত হয় জন্মের প্রথম পাঁচ বছরে। আর বাকি ৫ শতাংশ গঠিত হতে সময় লাগে পরবর্তী তিন বছর। সুতরাং আমাদের সন্তানের প্রথম ৮ বছর বাবা-মায়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম পাঁচ বছরের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এ সময় শিশুদের মস্তিষ্কের সংযোগ তৈরি হয় এবং যার যত বেশি মস্তিষ্ক সংযোগ হবে সে তত বেশি মেধাসম্পন্ন হবে।
সুতরাং এসময় সন্তানের মস্তিষ্কের সংযোগ বাড়াতে বাচ্চাকে রঙিন খেলনা, পুষ্টিকর খাবার, পারিবারিক শিক্ষা, তাদের সাথে খেলা এবং গল্প করা অত্যন্ত জরুরি। অথচ এখনো অনেক বাবা-মা কিছু হলেই বাচ্চাকে শাস্তি, জোর করে পড়তে বসানো ইত্যাদি করে থাকি। যা আমাদের সন্তানের জন্য এবং মেধা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
শিশুর বিকাশে যা করণীয়
আমাদের শিশুদের প্রাথমিক বিকাশে কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় রয়েছে, যা আমাদের সকলের জেনে রাখা অত্যন্ত জরুরি।
সময় মত টিকা দিন
সন্তানের ঠিকমতো পুষ্টির প্রাপ্তি ঘটাতে এবং মেলামেশা ও শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে সময় মত টিকা দেওয়া জরুরি। কিন্তু আমরা অনেকেই এই ভুল করে থাকি, সময় মত টিকা না দিলে বাচ্চাদের অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হওয়ার আগে সতর্ক থেকে সময় মত সব ধরনের টিকা দিয়ে সন্তানকে সুস্থ রাখা একজন পিতা মাতার দ্বায়িত্ব।
সঠিক খাদ্য নির্বাচনে পরিকল্পনা করুন
জন্মের প্রথম ৬ মাস শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ এবং প্রথম ২ বছর দিতে হবে নিরাপদ বিকল্প খাবার। নিরাপদ খাবারের পাশাপাশি বুকের দুধ চলতে থাকবে ২ বছর এবং বাহিরের প্যাকেট বা অন্য কোনো দুধ দেওয়া যাবে না।
তবে চাল, ডাল, সোয়াবিন অথবা অলিভ ওয়েল এবং সবজি মিশ্রিত খিচুড়ি একমাত্র সুষম খাদ্য, যাতে সকল প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড পাওয়া সম্ভব। পাশাপাশি ডিম, মাছ, মাংস, সবজি খাওয়ান এবং দিনে একবার হলেও যেকোন ফল খেতে দিন যাতে বাচ্চা সুস্থ থাকে।
শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক যত্নের প্রতি মনযোগী হন।
প্রথম অবস্থায় শিশুরা যেরকম যত্ন বা ভালোবাসা পেয়ে বড় হতে থাকে তা শিশুদের সারা জীবনের উপর প্রভাব ফেলে। এই জন্য মা-বাবা এবং পরিবারের সকলের উচিত প্রথম থেকেই শিশুদের সঠিকভাবে যত্ন নিয়ে যত্নশীল করে গড়ে তোলা। আমাদের দেশে সন্তানের যত্নের প্রতি মায়েরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে, এখানেই আমরা ভুল করছি। মায়ের গুরুত্বের পাশাপাশি বাবার গুরুত্বের ভূমিকা অপরিসীম। সুতরাং সন্তানকে সুন্দর মানসিকতা এবং শিষ্টাচার শিক্ষা দিতে বাবা এবং মায়ের সন্তানের যত্নের প্রতি সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
খেলাধুলা করতে উৎসাহ প্রদান করুন
শিশুদের খেলনা অথবা খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের সামাজিকতা, শিক্ষা, শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধি বিকাশ এবং জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। শিশুদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত বিকাশ দ্রুত বাড়াতে পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলনা কিনে দিন। পাশাপাশি ঘরের বাহিরে নিয়ে সমবয়সি অথবা প্রতিবেশীদের সাথে মিলেমিশে খেলার সুযোগ করে দিন। যাতে করে সামাজিকতা এবং মানুষের মনোভাব বুঝতে সক্ষম হয়।
নতুন কিছু অর্জন করতে সহযোগীতা করুন
আমাদের প্রত্যেক শিশুদেরই ছোট থেকে জানার আগ্রহ বেশি থাকে, অনেক সময় আমরা বাধা দিয়ে থাকি। মূলত জানা এবং শেখার আগ্রহ বেশি থাকলে শিশুদের বাধা না দিয়ে তাদের জানা এবং শেখার আগ্রহ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করুন, যার ফলে বাচ্চার মেধা বিকাশের পাশাপাশি নতুন কিছু অর্জন করার প্রবণতা বাড়বে।
অন্যদের সাথে মিশতে সাহায্য করুন
বাবা-মা ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষকরা শিশুদের সঙ্গে যত বেশি কথা বলবে, ঠিক তত তাড়াতাড়ি তারা শিখতে পারবে। সুতরাং অন্যদের সাথে মিশতে দিলে, তাদের মুখ দেখলে, পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনলে শিশুদের মন বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি উদ্দীপনা এবং আবেগজনিত বিকাশ ঘটে।
শিশুকে ভয় এবং শাস্তি থেকে বিরত রাখুন
আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মা বাবারা সামান্য কিছু নিয়ে শিশুদের উপর শারীরিক শাস্তি দিয়ে থাকি যার ফলে শিশুদের মনো বিকাশের ক্ষতি হয়। শিশুকে শারীরিক শাস্তি বা উৎপীড়ন না করে তাদের সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলুন কোনটা ভাল, কি করা উচিৎ এবং কি করা উচিৎ নয়। সন্তান ভালো কিছু করলে প্রশংসা এবং পরিবার ও সমাজের ভাল মানুষ হতে উৎসাহিত করুন।
শিশুদের গতিবিধি খেয়াল রাখুন
আমাদের শিশুরা নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয় এবং নতুন কিছু জানা এবং ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। এ সময় প্রতিটি বাবা-মা এবং শিক্ষকের উচিৎ সন্তানের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা। যাতে করে ভুল কিছু করতে থাকলে খারাপ ব্যবহার না করে তাকে সঠিক ভাবে বুঝিয়ে বলা। অপরদিকে ভাল কিছু করলে তাকে উৎসাহ দিয়ে পরবর্তীতে ভাল কিছু করার আগ্রহ সৃষ্টি করা।
উপরে যে বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তা সকল পিতা মাতার পালন করা একটি দ্বায়িত্বের মধ্যে পরে। আমাদের পিতা মাতার সামান্য কিছু ভুল অথবা দ্বায়িত্বহীনতার অভাবে একটি শিশুর স্বাস্থ্য ও জীবন ভয়ংকর হতে পারে। এবং শুরু থেকেই পিতা মাতার সঠিক দ্বায়িত্ব বোধের কারণে প্রতিটি সন্তানের শারীরিক সুস্থ্যতা, মানসিকতা, সামাজিকতা সকল কিছু সঠিক ভাবে সম্পূর্ন হবে। সুতরাং সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে উপরোক্ত বিষয়গুলো প্রত্যেকটি বাবা এবং মায়ের জেনে রাখার পাশাপাশি পালন করতে হবে।
এরকম ভাল এবং শিক্ষনীয় টিপস পেতে আমাদের পাশেই থাকুন। ধন্যবাদ